বৃহস্পতিবার ২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে গেলে দেশ বদলে যাবে

এম এ খালেক   |   বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫   |   প্রিন্ট   |   140 বার পঠিত

গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে গেলে দেশ বদলে যাবে

জাতীয় জীবনে গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এক সময় জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি অর্জিত হতো গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে। কালের বিবর্তনে গ্রামীণ অর্থনীতি আজ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এক সময় দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি বাস করতেন গ্রামে। বর্তমানে সেই অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ এখন গ্রামে বাস করে আর ৩৩ শতাংশ বাস করে শহরে; কিন্তু জাতীয় অর্থনীতিতে শহরের অবদান এখন ৬০ শতাংশেরও বেশি। জনসংখ্যা কৈ মাছের মতো উজান ধায়। বর্ষাকাল শুরু হলে কৈ মাছ যেমন উজানের দিকে ধাবিত হয় জনসংখ্যাও ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয় এমন অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। ফলে আমরা দেখছি, প্রতিদিন শহরমুখী মানুষের স্রোত ক্রমেই বাড়ছে। তবে অতি সম্প্রতি এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, শহর থেকে গ্রামমুখী জনস্রোত আগের তুলনায় কিছুটা হলেও বেড়েছে। তার অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে?

তাহলে কি গ্রামে এখন কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে? গ্রামের মানুষ কি কৃষির পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও তাদের শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে? বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ দিন ধরে গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর নিয়ে গবেষণা করছি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই। গ্রামের মানুষ এখন আর শুধু সনাতনি পদ্ধতির কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত নেই। তারা নন-ফার্মিং এক্টিভিটিজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই কৃষির পাশাপাশি নানা ক্ষুদ্র উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের আয় বর্ধন করছেন। তিনি আরও বলেন, বিগত শতাব্দীর আশির দশকে একজন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, গ্রামে বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে উন্নয়ন শুরু হবে। গ্রামের মানুষ সন্ধ্যার পর কোনো কাজ না থাকায় ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের জন্য যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তারা বিভিন্ন কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারবেন। বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দুটি উৎপাদন উপকরণ আবশ্যক। এর মধ্যে একটি হচ্ছে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্যুৎ সুবিধা সম্প্রসারিত করা। বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক শাসনামলে দেশের অধিকাংশ গ্রামই এখন বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এসেছে। খুব কম গ্রামই আছে যেখানে এক বা একাধিক পাকা রাস্তা নেই। গ্রামের মানুষ এখন শহরের সুবিধা ভোগ করছেন। কালার টিভি, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক বাতি বা এয়ারকুলার এখন গ্রামেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রাণ হচ্ছে গ্রাম। এখনো গ্রামের উন্নয়ন বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং অগ্রগতি প্রত্যাশা করা যায় না। বর্তমানে শহরের অনেক সুবিধাই গ্রামে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। কম্পিউটার ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ করার মতো উপযোগী পরিবেশ তারা পাচ্ছে। অনেকেই এখন গ্রামে থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করে অর্থ উপার্জন করছেন। শহরাঞ্চলে তুলনায় গ্রামে জমির সহজলভ্যতার কারণে উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন শহরের পরিবর্তে গ্রামে তাদের শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে শুরু করেছেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এবং গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে গ্রামীণ জীবনে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে চমৎকার ইতিবাচক রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যারা এক সময় গ্রামে বিত্তবান পরিবার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাদের অনেকেই শহরে চলে আসছেন। গ্রামে থাকা তাদের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই সম্পত্তি ক্রয় করছেন এক সময় যে পরিবারগুলো নিঃস্ব ছিল তারাই।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক ইতিবাচক রূপান্তর প্রক্রিয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থান উপলক্ষে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই গ্রামের অশিক্ষিত এবং দরিদ্র পরিবার থেকে আগত। অনেক ক্ষেত্রে এরা জমি-বাড়ি বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমায়। এক সময় তারা বিত্ত-বৈভব অর্জন করে দেশে ফিরে আসে। তারা দেশে ফিরে আসার পর প্রথমেই তারা হারানো জমিজমা উদ্ধারের চেষ্টা করে। যে জমি বিক্রি করেছিল, তা যদি ক্রয় করা সম্ভব নাও হয় তারা অন্য কোনো পরিবারের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে থাকে। গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে যেসব সদস্য বিদেশে কর্মসংস্থান করে তারা দেশে ফিরে প্রথমেই শিল্প-কারখানা স্থাপনের চিন্তা না করে জমি ক্রয় করে। মূলত এ কারণেই রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশই আয়বর্ধক বিনিয়োগের বাইরে থেকে যাচ্ছে। তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠা এবং গতিশীল হবার পেছনে জনশক্তি রপ্তানি খাত ব্যাপক অবদান রেখেছে।

গ্রামীণ অর্থনীতিকে আগামীতে আরও চাঙ্গা করার জন্য এখনই আমাদের ভাবতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি নির্ভরতার পরিবর্তে শিল্পায়নের দিকে নিয়ে যেতে হবে। কৃষি খাতে উৎপাদিত পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যকে কাঁচা বিক্রি করার চেয়ে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বাজারজাত করা গেলে উৎপাদকদের আয় অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে। কৃষিকে শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজে পরিণত করতে হবে। অর্থাৎ শিল্প খাতের কাঁচামাল যাতে কৃষি সেক্টর থেকে জোগান দেয়া সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যারা উৎপাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সেই কৃষক অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব আবাদযোগ্য জমি নেই। ফলে তারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে অথবা বর্গা নিয়ে চাষ করে। কিন্তু এখনো গ্রামে বর্গাচাষিদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক প্রদান করা হয়। এই আইন পরিবর্তন করার প্রয়োজন রয়েছে। এক সময় আমাদের দেশে তেভাগা আন্দোলন বেশ গতি পেয়েছিল। তেভাগা আন্দোলনের মূল কথাই হচ্ছে, জমির মালিক যদি কৃষকের সঙ্গে আবাদের খরচ সমহারে প্রদান না করে, তাহলে উৎপাদিত ফসল তিন ভাগ করতে হবে। এর মধ্যে জমির মালিকানা সূত্রে একভাগ মালিক। আর জমি আবাদের ব্যয়ভার বহনের জন্য চাষি পাবেন দুই ভাগ। তেভাগা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা গেলে গ্রামীণ ভূমিহীন কৃষকের খুবই উপকার হতো। তারা জমিতে বেশি ফসল ফলানোর জন্য তৎপর হতেন।

আমাদের দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম। তাই চাষযোগ্য জমি যাতে নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামে যেসব আবাদযোগ্য জমি আছে, তার বেশির ভাগই এক ফসলি অথবা দুই ফসলি। ফলে অধিকাংশ জমিই বছরের বেশির ভাগ সময় পতিত পড়ে থাকে। পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি এবং দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত আইন অনুসারে আবাদযোগ্য জমির মাটি কাটা নিষিদ্ধ রয়েছে। আইনের এই ধারাটি প্রায়ই অপব্যবহার করা হচ্ছে। আবাদযোগ্য জমিতে কেউ যদি পুকুর কেটে মাছ চাষ করে, তাহলে আপত্তি উত্থাপন করা হবে কেন? ফসলি জমিতে যেমন ফসল আবাদ করা প্রয়োজন তেমনি মাছ চাষও করা যেতে পারে। গ্রামে এখনো বিস্তীর্ণ জমি অনাবাদি পড়ে আছে। এগুলোকে পরিকল্পিতভাবে চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

গ্রামাঞ্চলে যে সব আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার আধিকাংশই অপরিকল্পিত। গ্রামে কোনো পরিবারের সদস্য আলাদা হয়ে গেলে, তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন বাড়ি নির্মাণ করে থাকেন। এসব বাড়ির আশপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা পতিত পড়ে থাকে। এটা চলতে দেয়া যায় না। কোনো পরিবারের তিনজন সদস্য যদি আলাদা (ভিন্ন) হয়ে যান, তাহলে তারা সবাই যার যার মতো বাড়ি নির্মাণ করে থাকেন। এতে আবাদযোগ্য জমির অপচয় হয়। তাই এ ক্ষেত্রে একটি আইনি সংস্কার সাধন করা যেতে পারে। অভিভাবকের মৃত্যু অথবা অন্য কোনো কারণে একটি পরিবারের সদস্যরা যদি আলাদা হয়ে যান, তাহলে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একই বাড়িতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে সেখানে বসবাসে বাধ্য করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আর্থিক সহায়তা করা যেতে পারে। সাবির্কভাবে গ্রামোন্নয়নের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সঠিকভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা করা না গেলে আগামীতে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে।

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১:১১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

প্রতিদিনের অর্থনীতি |

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

January 2025
SSMTWTF
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031

এক ক্লিকে বিভাগের খবর

সম্পাদক:
এম এ খালেক
Contact

মাকসুম ম্যানশন (৪র্থ তলা), ১২৭, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

০১৮৮৫৩৮৬৩৩০

E-mail: protidinerarthonity@gmail.com